ডায়াবেটিস শরীরে শুধু রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়িয়ে দেয় না, বরং এর কারণে দেখা দিতে পারে নানা ধরনের চর্মরোগ। এদের মধ্যে অন্যতম এবং গুরুতর একটি সমস্যা হলো ডায়াবেটিক ফুট আলসার, যা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ব্যক্তির পায়ে তৈরি হওয়া একটি খোলা ঘা বা ক্ষত। সময়মতো এবং সঠিক চিকিৎসা না হলে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে, এমনকি অঙ্গচ্ছেদের (amputation) ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে।
আলসার সৃষ্টির প্রধান কারণ
ডায়াবেটিক ফুট আলসার সৃষ্টির মূলে কাজ করে মূলত তিনটি প্রধান কারণ:
১. পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি (Peripheral Neuropathy):
ডায়াবেটিস পায়ের স্নায়ুকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যাকে পেরিফেরাল নিউরোপ্যাথি বলা হয়। এর ফলে পায়ে ব্যথার অনুভূতি কমে যায় বা সম্পূর্ণ লোপ পায়। একজন ডায়াবেটিক রোগী হয়তো পায়ে কোনো ধারালো বস্তুর আঘাত বা জুতার ঘষা অনুভব করতে পারেন না। ফলে ছোট আঘাতও নজরের বাইরে থেকে যায় এবং আলসারে পরিণত হওয়ার সুযোগ পায়। এর পাশাপাশি, এই রোগীদের ক্ষত নিরাময় প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হয়।
২. শুষ্ক ত্বক ও ক্যালাস (Callus) গঠন:
ডায়াবেটিসের কারণে ত্বক শুষ্ক হয়ে যায়, যা পায়ে ক্যালাস (ত্বকের পুরু, শক্ত অঞ্চল) গঠনে সহায়তা করে। বারবার ঘষা লাগার ফলে এই ক্যালাস যখন উঠে যায় বা ফেটে যায়, তখন তা আলসারে রূপ নিতে পারে।
৩. রক্তনালীর ক্ষতি (Decreased Blood Flow):
ডায়াবেটিস রক্তনালীকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে পায়ের নিচের অংশে রক্ত চলাচল কমে যায়। রক্তপ্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় ক্ষতস্থানে সংক্রমণ হওয়ার এবং তা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
ফুট আলসারের লক্ষণসমূহ
ডায়াবেটিক ফুট আলসার দেখা দিলে সাধারণত যেসব লক্ষণ প্রকাশ পায়:
ক্ষতস্থান থেকে তরল নিঃসরণ (drainage)।
পায়ের আক্রান্ত স্থানে লালচে ভাব এবং ফোলা।
ক্ষতস্থান থেকে দুর্গন্ধ নির্গত হওয়া।
পায়ে ব্যথা বা অবসন্নতা (numbness) অনুভব করা।
গুরুতর ক্ষেত্রে, রক্ত সরবরাহের অভাবে আলসারের চারপাশে কালো অঞ্চল তৈরি হওয়া।
আক্রান্ত স্থানে কোষের মৃত্যু অর্থাৎ গ্যাংগ্রিন (gangrene) দেখা দেওয়া।
ঝুঁকি সৃষ্টিকারী কারণ এবং জটিলতা
ডায়াবেটিক ফুট আলসারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে কিছু বিষয়, যেমন—
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা: রক্তে শর্করার মাত্রা অনিয়ন্ত্রিত থাকলে।
পায়ের বিকৃতি: পায়ে এমন কোনো গঠনগত সমস্যা, যা পায়ের নির্দিষ্ট অংশে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করে।
ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার অভাব: পায়ের সঠিক যত্ন না নেওয়া।
ত্রুটিপূর্ণ জুতা ব্যবহার: বেমানান বা আঁটসাঁট জুতা পরা।
তামাক সেবন এবং স্থূলতা (obesity)।
আলসারের জটিলতার মধ্যে রয়েছে: সংক্রমণ, গ্যাংগ্রিন, সেলুলাইটিস (ত্বকের গভীর স্তরে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ) এবং অস্টিওমাইলাইটিস (হাড়ের গুরুতর সংক্রমণ)। সময়মতো ব্যবস্থা না নিলে এই জটিলতাগুলো অঙ্গচ্ছেদের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
প্রতিরোধ ও হোমিওপ্যাথিক ব্যবস্থাপনা
প্রতিরোধের উপায়
ডায়াবেটিক ফুট আলসার প্রতিরোধে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অত্যন্ত জরুরি:
রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ: ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
পায়ের সঠিক স্বাস্থ্যবিধি: নিয়মিত পা পরিষ্কার ও শুকনো রাখা।
উপযুক্ত জুতা পরিধান: আরামদায়ক এবং সঠিকভাবে ফিট হওয়া জুতা ব্যবহার করা।
নিয়মিত মোজা পরিবর্তন: পরিষ্কার মোজা পরিধান করা।
সঠিকভাবে নখ কাটা: নখ কোণাকুণি না কেটে সোজা করে কাটা।
ধূমপান ত্যাগ: তামাক সেবনের অভ্যাস থাকলে তা পরিহার করা।
হোমিওপ্যাথিক ব্যবস্থাপনা
হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ডায়াবেটিক ফুট আলসারের চিকিৎসায় সহায়ক হতে পারে। এই চিকিৎসা পদ্ধতি আলসারের নিরাময়ে সাহায্য করার পাশাপাশি এর সাথে সম্পর্কিত লক্ষণ যেমন—লালচে ভাব, নিঃসরণ, দুর্গন্ধ, চুলকানি ও জ্বালাপোড়া কমাতেও সহায়ক। এগুলো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন প্রাকৃতিক ওষুধ হিসেবে পরিচিত।
তবে মনে রাখা জরুরি:
হোমিওপ্যাথিতে ডায়াবেটিক ফুট আলসারের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ নেই। রোগীর সামগ্রিক লক্ষণ এবং অবস্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত ওষুধ নির্বাচন করা হয়।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা কেবলমাত্র আলসারের মৃদু ক্ষেত্রে নির্দেশিত।
গুরুতর বা জটিল ক্ষেত্রে অবিলম্বে প্রচলিত আধুনিক চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া উচিত, কারণ এসব ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি কোনো সাহায্য করতে পারে না এবং বিলম্বে পরিস্থিতি মারাত্মক হতে পারে।
যেকোনো হোমিওপ্যাথিক ওষুধ ব্যবহারের আগে অবশ্যই একজন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়। কোনো অবস্থাতেই স্ব-চিকিৎসা করা উচিত নয়।